আজ সুসময়ে মাঠ ভরিয়ে ফেলা সহজ, কিন্তু দুঃসময়ে বালুর ট্রাক সরানো বা জেলগেট পর্যন্ত দৌড়ানোটাই ছিল আসল পরীক্ষা। ভিড় দেখে বিভ্রান্ত হবেন না, দুর্দিনের পরীক্ষিত কর্মীদের মনে রাখুন।

সংখ্যাতত্ত্ব নয়, সংকটকালের পরীক্ষাই রাজনীতির আসল মানদণ্ড,
রাজনীতির মাঠে আজ ৫০ লাখ লোক সমাগম হলো নাকি ৫০ কোটি—একজন গণমাধ্যমকর্মী বা পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার কাছে এটা মূল বিচার্য বিষয় নয়। কারণ, সুসময়ের এই উপচে পড়া ভিড় দেখে রাজনৈতিক কর্মীদের আসল চরিত্র বা ত্যাগের গভীরতা মাপা কঠিন।
একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যান। বিগত দেড় দশকের সেই শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মনে আছে? যখন বিরোধী মতের জন্য রাজপথে দাঁড়ানোর ন্যূনতম ‘স্পেস’ বা সুযোগটুকুও অবশিষ্ট ছিল না। চারদিকে ছিল কেবল গায়েবি মামলা, হুলিয়া আর গ্রেপ্তারের আতঙ্ক। প্রশ্ন হলো, আজকের এই বিশাল জনসমুদ্র তখন কোথায় ছিল? তখন তো রাজপথ ছিল প্রায় জনশূন্য, হাতেগোনা কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছাড়া কাউকেই মাঠে দেখা যেত না।

অথচ আজ দৃশ্যপট ভিন্ন! মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ভিড়ের অনেকেই স্রোতের অনুকূলে গা ভাসানো মানুষ। ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে, দলের আসল চালিকাশক্তি তো তারাই—যারা চরম প্রতিকূলতায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল:
১. অবরুদ্ধ সময়ের লড়াকু সৈনিক: স্মৃতিতে ভাসে সেই দিনগুলো, যখন গুলশানে বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে বালুর ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছিল। সেই চরম অনিশ্চয়তার মুহূর্তেও যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল—তারাই তো আসল লড়াকু।
২. জেলগেটের সেই নিঃশর্ত অনুসারী: সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে যখন কারাগারে নেওয়া হচ্ছিল, তখন পুলিশি ভ্যানের পেছনে পেছনে যারা নির্ভীক চিত্তে জেলগেট পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েছিল—তাদের সেই আবেগ ছিল কৃত্রিমতামুক্ত। ওটাই ছিল দলের প্রতি প্রকৃত আনুগত্যের নিদর্শন।
৩. দুঃসময়ের বাতিঘর: যখন সবদিকে নিস্তব্ধতা, তখন রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে মাত্র ১০-১২ জন নিয়ে নয়াপল্টনে যারা ঝটিকা মিছিল করে বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল, তারাই আসলে দলের প্রাণভ্রমরা। শত নিপীড়নের মুখেও তারা হাল ছাড়েনি।

পর্যবেক্ষণ: আজকের এই বিজয়ের মিছিলে যারা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের অনেককেই সেই সংকটকালে নিরাপদ দূরত্বে বা আড়ালে থাকতে দেখা গেছে। আজ সুসময় দেখে তারা ‘নেতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। রাজনীতির ভাষায় এদের অনেকেই ‘সুবিধাবাদী’ বা ‘বসন্তের কোকিল’।
তাই কেবল সংখ্যার বিচারে নয়, মূল্যায়ন হোক ত্যাগের মানদণ্ডে। ইতিহাস সুবিধাবাদীদের মনে রাখে না, মনে রাখে তাদের—যারা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজপথে অবিচল ছিল।
